mango

বর্তমান শতাব্দীর শুরু থেকে বেশ কয়েক বছর পেশাগত কাজে খুলনা শহরে হরহামেশাই যেতে হয়েছে। খুলনা শহরের ডাকবাংলো মোড় এলাকাজুড়ে ছড়ানো-ছিটানো ফলের দোকান। দোকানগুলোতে ল্যাংড়া আম বিক্রি হচ্ছে দেদার।

মে মাসের শেষ দিকেই খুলনার বাজারে ল্যাংড়া আম! আমি রাজশাহীর মানুষ। আম সম্পর্কে, বিশেষ করে উৎকৃষ্ট জাতের আম নিয়ে আমাদের আগ্রহ ও সচেতনতা জন্মগত। ল্যাংড়া আম জুন মাসের ১৫ তারিখের আগে বাজারে আসবে—এ কথা কল্পনায়ও আসে না।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, খুলনার বাজারে আগাম ল্যাংড়া আম আসছে সাতক্ষীরা থেকে। সাতক্ষীরা সদর, দেবহাটা, কালীগঞ্জ ও কলারোয়া উপজেলা এলাকায় আমের চাষ হয়ে থাকে। সাতক্ষীরা সদর ও দেবহাটা থানা এ ব্যাপারে বেশি এগিয়ে। প্রথম প্রথম ধারণা জন্মায়, সাতক্ষীরার ল্যাংড়া হয়তোবা বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকা, বিশেষ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর কিংবা দিনাজপুর অঞ্চলে উৎপাদিত ল্যাংড়া আমের চেয়ে অনেকটাই আশু বা আগাম পরিপক্বতা লাভ করে। এ ধারণা নিয়ে বেশ কয়েক বছর অতিবাহিত হলো।

আমবিষয়ক একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থের প্রকাশনার কাজের জন্য ২০১০ সালে সাতক্ষীরায় যেতে হলো। সাতক্ষীরা সদর ও দেবহাটা উপজেলায় একাধিক আমবাগান স্বচক্ষে দেখলাম। আমচাষি, বাগানমালিক, আম ব্যবসায়ী ও আম-সংশ্লিষ্ট অনেক মানুষের সঙ্গে কথা হলো। আমবিষয়ক অনেক তথ্যের আদান-প্রদান ঘটল। একটি বিষয়ে পরিষ্কার হওয়া গেল—এখানকার বাগানের ল্যাংড়া আম আগাম পরিপক্ব হয় না। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর অঞ্চলের ল্যাংড়ার সঙ্গে তা পোক্ত হয়।

 

mango
পাশাপাশি আরও কয়েকটি বিষয়ে নিশ্চিত হলাম। সাতক্ষীরা অঞ্চলে গোবিন্দভোগ ও বোম্বাই—এ দুই জাতের আমের ফলন বেশি হয়। এর মধ্যে গোবিন্দভোগ আশু জাতের। বোম্বাই মধ্য মৌসুমি। সাতক্ষীরা অঞ্চলে ক্ষীরশাপাত আমের উৎপাদন কম নয়। ইদানীং রানিপছন্দ আম উৎপাদিত হচ্ছে সাতক্ষীরা অঞ্চলে। কিন্তু আমাদের জন্য এখন অস্বস্তির কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে এই সাতক্ষীরার আম। বাংলাদেশের মানুষ যে জাতের আমগুলোর সঙ্গে অধিক পরিচিত, সেগুলোর মধ্যে গোপালভোগ, ক্ষীরশাপাত ও হিমসাগর, ল্যাংড়া, রানিপছন্দ, ফজলি, আশ্বিনা, লক্ষ্মণভোগ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ইদানীং যোগ হয়েছে আম্রপালি, হাঁড়িভাঙা, মল্লিকা। সাতক্ষীরা থেকে ব্যাপকভাবে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাজারে আসছে গোপালভোগ, ক্ষীরশাপাত, রানিপছন্দ, ল্যাংড়া ও গোবিন্দভোগ আম। সাতক্ষীরার উল্লিখিত জাতের আমগুলো পরিপক্ব হওয়ার ২০-২৫ দিন আগেই গাছ থেকে সংগ্রহ করে জোরজবরদস্তি পাকানো হচ্ছে।

গোবিন্দভোগ আম পরিপক্ব হয় মে মাসের ২০ তারিখ পার করে। অথচ ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাজারে গোবিন্দভোগের প্রথম চালান আসে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে। ধারণা করতে অসুবিধা হয় না, কার্বাইড ব্যবহার করে সে আম পাকানো হয়েছে। রাজধানীর মানুষ আগাম সে আম কিনছেন একটু বেশি দাম দিয়েই। কিন্তু খাবার টেবিলে আমের আসল স্বাদ পাচ্ছেন না। খুবই স্বাভাবিক। আম পোক্ত হওয়ার ১৫-২০ দিন আগেই গাছ থেকে নামালে আসল স্বাদ আসবে না। টক ভাব থেকেই যাবে। রসাল হবে না। সুগন্ধি থেকেও ভোক্তা হবেন বঞ্চিত।

এরপর গোপালভোগ। অতি উৎকৃষ্ট এই জাতের আম পোক্ত হতে শুরু করে মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে। আমরা ধরে নিতে পারি, মে মাসের ২৫ তারিখের পর থেকে গোপালভোগ আম বাজারে এলে দোষের কিছু নেই। তবে যিনি গোপালভোগ আমের আসল সমঝদার, তিনি জুন মাসের ১ তারিখের আগে কখনোই এই উৎকৃষ্ট স্বাদের আমটি খেতে চাইবেন না। অথচ সাতক্ষীরা থেকে অপরিপক্ব গোপালভোগ আম জোর করে পাকিয়ে মে মাসের ১০-১২ তারিখেই ঢাকার বাজারে তোলা হয়।

fresh mango
ক্ষীরশাপাত বা হিমসাগর আম বাংলাদেশের অতি উৎকৃষ্ট জাতের আমগুলোর মধ্যে একটি। ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রামের মানুষ হিমসাগর আমের বড় ভোক্তা। হিমসাগরের প্রতি এদের দুর্বলতা যেন জন্মগত। হিমসাগর বা ক্ষীরশাপাত আম পোক্ত হতে শুরু করে জুন মাসের ১০-১২ তারিখের পর থেকে। ক্ষীরশাপাত কিংবা হিমসাগর আমের বনেদি ভোক্তারা জুন মাসের ১৫ তারিখের আগে কখনোই এই আম ক্রয় করতে উৎসাহী হবেন না। না হওয়াই উচিত। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, মে মাসের ১৫ তারিখের মধ্যেই ঢাকার বাজারে ক্ষীরশাপাত আমের ছড়াছড়ি। বিক্রি হচ্ছে হিমসাগর বলে। ঢাকার নাগরিকদের দুর্বলতার জায়গায় প্রতারণা করে অপরিপক্ব আম খাওয়ানো হচ্ছে।

জুন মাসের ১৫ তারিখের আগে ল্যাংড়া আম বাজারে এলে সেই আম কখনোই কেনা উচিত হবে না। অতি উৎকৃষ্ট এবং দামি এই জাতের আম অপরিপক্ব অবস্থায় বেশি পয়সা খরচ করে কেনার কোনো যুক্তি নেই। ধারণা করছি, মে মাসের ২৫ তারিখের মধ্যেই শুরু হবে সাতক্ষীরা থেকে ল্যাংড়ার চালান আসা। এই আম খেতে মোটেই সুস্বাদু হবে না।

বাংলাদেশের আম ভোক্তাদের বিশেষ করে ঢাকা, কুমিল্লা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট জেলার অগণিত আম ভোক্তার অবগতির জন্য প্রাকৃতিক নিয়মে আম পরিপক্ব হওয়ার সময়পঞ্জি (ক্যালেন্ডার) দেওয়া হলো। ভোক্তা সচেতনভাবে সঠিক সময়ে তাঁর পছন্দের আমটি ক্রয় করতে পারলে বিষমুক্ত আমের প্রভাব থেকে নিজেকে ও পরিবারের অন্য সদস্যদের মুক্ত রাখতে সক্ষম হবেন।

আম কত দিনে পুষ্ট হয়

আমের নাম পরিপক্বতার সময়
গোবিন্দভোগ ২৫ মের পর
গুলাবখাস  ৩০ মের পর
গোপালভোগ ১ জুনের পর
রানিপছন্দ  ৫ জুনের পর
হিমসাগর বা ক্ষীরশাপাত  ১২ জুনের পর
ল্যাংড়া  ১৫ জুনের পর
লক্ষ্মণভোগ ২০ জুনের পর
হাঁড়িভাঙা ২০ জুনের পর
আম্রপালি  ১ জুলাই থেকে
মল্লিকা  ১ জুলাই থেকে
ফজলি ৭ জুলাই থেকে
আশ্বিনা  ২৫ জুলাই থেকে
মাহবুব সিদ্দিকী, লেখক ও গবেষক। প্রকাশিত গ্রন্থ আম।

 


Comments are closed.