মধুতে মুখ মিষ্টি তো হয়ই, সেই সঙ্গে জীবনও মিষ্টি হয়ে উঠতে পারে। কারণ মধুর রয়েছে প্রাকৃতিকভাবে সারিয়ে তোলার শক্তি। সেই শক্তির কথাই সবিস্তারে জানিয়ে দিচ্ছি।      

মধুর ইতিহাস

সুমিষ্ট মধুর ঔষধি ব্যবহার দেখা গেছে প্রাচীন মিশরীয়দের আমল থেকে। শরীরে ক্ষতস্থানে বা ঘাঁয়ের ওপর মধু লাগিয়ে রাখতেন মিশরীয়রা। এতে সেই ক্ষত বা ঘাঁ জলদি শুকিয়ে যেতো। নানা ধরনের চামড়ার রোগেও ঔষধ হিসেবে কাজে লাগানো হতো মধু।

আমাদের মা-খালারা আজও সর্দি-কাশিতে মধু খাওয়ার কথা বলেন। শুকনো কাশি হলে মধু খেয়ে শুতে গেলে রাতে ভালো ঘুম হয়, এ কথা মানেন অনেকেই। কফ সিরাপের জায়গা খুব সহজেই নিতে পারে মধু।

যেসব ফুল থেকে মধুঃ
সাধারণভাবে বিভিন্ন ফুল থেকে মধু হয় তার মধ্যে কিছু হল – সরিষা ফুল, লিচু, সুন্দর বন, কালজিরা থেকে মধু আহরিত হয়। এ ছাড়াও রয়েছে ধনিয়া ফুল, গুজি তিল ও তৃষি থেকেও মধু উত্‍পাদিত হয়ে থাকে। প্রায় সব উপাদান বা ফুল থেকে যে মধু আসে তার সবগুলার গুনাগুন প্রায় একই।

সবচেয়ে সেরা মধুঃ
আমরা বিভিন্ন উপায়ে মধু সংগ্রহ করে থাকি তবে নিউজিল্যাণ্ডের মানুকা হানি বাজারে প্রাপ্য সকল মধুর চেযে বেশী ঔষধি গুণ সম্পন্ন গণ্য করা হয়। সাধারানত মানুকা নামীয় এক প্রকার ঝোপ জাতীয় উদ্ভিদের ফুল থেকে উত্‍পন্ন মধু “মানুকা হানি” নামেও পরিচিত।

কিভাবে কাজ করে মধু?

মধু কিভাবে কাশির উপশম ঘটায় সে রহস্য এখনও পুরোপুরি উদঘাটন করতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। তবে এ নিয়ে অনেক রকম তত্ত্ব রয়েছে।

শুকনো কাশি তখনই হয় যখন শ্বাসনালীতে প্রদাহ হয়। এ প্রদাহের ফলে শ্বাসনালীর কোষগুলো থেকে নানা ধরনের রাসায়নিক পদাথর্ নিঃসরিত হয়। ধারণা করা হয় আঠালো মধু এ পদার্থগুলোকে নিঃসরিত হতে দেয় না, ফলে কাশি কমে যায়। এছাড়াও মধুতে অ্যান্টিসেপ্টিক এবং অ্যান্টিবায়োটিক উপাদান রয়েছে বলে মনে করা হয়। আর মধু দেহের বেশ কয়েকটি অংশে প্রদাহ কমাতেও সাহায্য করে।

মধু খেতে মানা যাদের

ছোট বড় সবাইকেই মধু খেতে দেয়া যায়। তবে খেয়াল রাখবেন, আপনার শিশুর বয়স যদি হয় ১২ মাসের কম, তাহলে তাকে মধু দেয়া ঠিক হবে না। কারণ দুর্লভ হলেও মধুতে বটুলিজম বীজাণু থাকার ঝুঁকি থাকে। এক বছর বয়সের আগে শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালোভাবে গড়ে ওঠে না। কাজেই এই ঝুঁকি না নেয়াই ভালো।

কাশি হলে মধু খাওয়ার নিয়ম:

# শুকনো কাশি হলে কয়েক ঘণ্টা পরপর দু-এক চামচ মধু খেয়ে নিতে পারেন, বিশেষ করে রাতে ঘুমানোর আগে।

# যদি এতে কাজ হয়, তবে মধু খাওয়া চালু রাখুন।

# বুকে কফ হলে তা থুতু হিসেবে ফেলে দিন, কফ কখনও রেখে দেবেন না।

# ৫-৭ দিনের বেশি যদি আপনার কাশি থাকে, তাহলে দেরি না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন।

 

মধুর যত উপকারিতা

আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন- তার পেট থেকে বিভিন্ন রঙের পানীয় নির্গত হয়। তাতে মানুষের জন্য রয়েছে রোগের প্রতিকার (সূরা নাহল এর আয়াত ৬৯)।
আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) থেকে বর্ণিত, মধু মৃত্যু ব্যাতিত যেকোনো রোগ দূর করতে সক্ষম।

আসুন এবার জেনে নাওয়া যাক মধুর উপকারিতা

 

. মধু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় সাধারানত প্রাকিতিক মধুতে আছে প্রচুর পরিমাণে মিনারেল, ভিটামিন ও এনজাইম যা শরীরকে বিভিন্ন অসুখ বিসুখ থেকে রক্ষা করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এছাড়াও প্রতিদিন সকালে এক চামচ মধু খেলে ঠান্ডা লাগা, কফ, কাশি ইত্যাদি সমস্যা কমে যায়। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হলে প্রতিদিন হালকা গরম জলের সাথে মধু ও লেবুর রস মিশিয়ে খান।

 

. ওজন কমায় মধু আপনি যদি প্রতিদিন সকালে মধু খান তাহলে আপনার বাড়তি ওজন কমবে। বিশেষ করে যদি পারেন সকালে খালি পেটে হালকা গরম জলে লেবুর রস ও মধু মিশিয়ে খান এতে করে বেশ খানিকটা ওজন কমে যায় কিছুদিনের মধ্যেই। এছাড়াও এভাবে প্রতিদিন নিয়মিত মধু খেলে লিভার পরিষ্কার থাকে, শরীরের বিষাক্ত উপাদান গুলো বের করে দেয় এবং শরীরের মেদ গলে বের হয়ে যায়।

 

. মধু খেলে বুদ্ধি বাড়ে মধু যে শুধু আপনার কায়িক শক্তি বাড়ায়, তা নয়। আপনি নিয়মিত প্রতিদিন রাতে শোয়ার আগে এক চামচ মধু খাবেন, কারন ঘুমানোর আগে এক চামচ মধু মস্তিষ্কের কাজ সঠিক ভাবে চালাতে খুব সাহায্য করে ফলে আপনার মস্তিষ্কের শক্তি তথা বুদ্ধির জোর বেড়ে যাবে। যে কোনো কাজে কর্মে আপনার মগজ আগের চেয়ে বেশি কাজ করবে। যাদের সাধারণত মাথা খাটিয়ে কাজ করতে হয়, তাদের জন্য মধু এনে দেবে নতুন উদ্যম ও সৃষ্টিশীলতা।

 

. হৃত্পিণ্ডের সমস্যার ঝুঁকি হ্রাস করতে মধু মধুর সাথে দারচিনির গুঁড়ো মিশিয়ে খেলে তা রক্তনালীর বিভিন্ন সমস্যা দূর করে এবং রক্তনালী পরিষ্কার করতে সাহায্য করে এবং রক্তের খারাপ কোলেস্টেরলের পরিমাণ ১০% পর্যন্ত কমিয়ে দেয়। মধু ও দারচিনির এই মিশ্রণ নিয়মিত খেলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুকি অনেকাংশে কমে যায় এবং যারা ইতিমধ্যেই একবার হার্ট অ্যাটাক করেছেন তাদের দ্বিতীয়বার অ্যাটাকের ঝুকি কমে যায়।

 

. ব্যথা নিরাময়ে আপনার শরীরের কি জয়েন্টে জয়েন্টে ব্যথা? প্রচুর বাতের ওষুধ খেয়েও আজও কোনো ফল পাননি? তাহলে আজ থেকে মধু খাউয়া শুরু করুন। আপনার শরীরে যে অবাঞ্ছিত রসের কারণে বাতব্যামোর জন্ম, সে রস অপসারিত করতে মধু বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। কিছু দিন পর আপনার বাত ব্যাথা সেরে যাবে।

 

. হজমে সাহায্য করে মধু যাদের নিয়মিত হজমের সমস্যায় ভুগেন তারা প্রতিদিন সকালে নিয়মিত মধু খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। মধু আপনার পেটের অম্লীয়ভাব কমিয়ে হজম প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে। হজমের সমস্যা অনেকাংশে দূর করার জন্য মধু খেতে চাইলে প্রতিবার ভারী খাবারের আগে এক চামচ মধু খেয়ে নিন। বিশেষ করে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে এক চামচ মধু খান।

 

. শক্তি বাড়াতে মধু মধুতে আছে প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক চিনি। এই প্রাকৃতিক চিনি আপনার শরীরে শক্তি যোগায় এবং শরীরকে কর্মক্ষম রাখতে সাহায্য করে। বিশেষ করে যাদের মিষ্টি খাবারের নেশা অনেক আছে তারা অন্য মিষ্টি খাবারের বদলি হিসাবে মধু খেয়ে নিন। কিছু মানুষ আছে যারা সারাক্ষন দূর্বলতায় ভোগেন এবং দেখা যায় এই সমস্যা দূর করার জন্য তারা কিছুক্ষন পর পর চা কফি খায়। এই সমস্যায় যারা ভুগছেন তারা প্রতিদিন সকালে নিয়মিত এক চামচ মধু খেয়ে নিন এবং সারা দিন সবল থাকুন।

 

. যৌন দুর্বলতায়– সাধারণত পুরুষদের মধ্যে যাদের যৌন দুর্বলতা রয়েছে তারা যদি প্রতিদিন মধু ও ছোলা মিশিয়ে খেতে পারেন। তাহলে একটা সময় বেশ উপকার পাবেন। প্রখ্যাত কিছু মধু বিজ্ঞানীদের মতে দৈনিক লিঙ্গে মধু মাখলে লিঙ্গ শক্ত ও মোটা হয় এবং সহবাসে দীর্ঘসময় পাওয়া যায়। নিয়মিত মধু সেবন করলে ধাতু দুর্বল (ধ্বজভঙ্গ) রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

 

. রক্ত পরিষ্কারক– এক গ্লাস হালকা গরম জলের সাথে এক বা দুই চামচ মধু এবং এক চামচ লেবুর রস মেশান। পেট খালি করার আগে প্রতিদিন এই মিশ্রিত জল খান। এটা রক্ত পরিষ্কার করতে অনেক সাহায্য করে। তাছাড়া রক্তনালী গুলোও পরিষ্কার করে থাকে।

 

১০. হাঁপানি রোধে– আপনি যদি পারেন আধা গ্রাম গুঁড়ো করা গোলমরিচের সাথে সমপরিমাণ মধু এবং আদা মেশান। আপনি দিনে অন্তত তিন বার এই মিশ্রিত জল খান। এটা হাঁপানি রোধে সহায়তা করবে।

 

১১. গ্যাস্ট্রিক আলসার থেকে মুক্তি আপনার হজম সমস্যার সমাধানেও কাজ করে মধু। একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, গ্যাস্ট্রিক আলসার থেকে মুক্তি পেতে একজন ব্যক্তি প্রতিদিন নিয়মিত তিন বেলা দুই চামচ করে মধু খেতে পারে। এতে করে গ্যাস্ট্রিক আলসার থেকে মুক্তি পেতে পারেন।

 

১২. মধু আয়ু বৃদ্ধি করে গবেষণায় আরও দেখা গেছে, নিয়মিত যারা মধু ও সুষম খাবারে অভ্যস্ত তুলনামূলক ভাবে সেসব ব্যাক্তিরা বেশি কর্মক্ষম ও নিরোগ হয়ে বেঁচে থাকে।

 


No comments so far.

Leave a Reply